ব্যাকরণ

ধ্বনি পরিবর্তন উদাহরণ সহ

ধ্বনি পরিবর্তন: বাংলা (মৌখিক) ভাষার শব্দের উচ্চারণে কতকগুলি বিশেষ নিয়মে কখনও কখনও শব্দের আদিতে ও মধ্যে ধ্বনির আগমন হয়। শব্দের অন্তর্গত কোন ধ্বনি কখনও বা অন্য ধ্বনিতে পরিবর্তন লাভ করে। শব্দ-মধ্যকার দুটি ধ্বনি আবার কখনও পরস্পর স্থান বিনিময় করে। কিংবা ধ্বনি লােপ পেয়ে যায়। বিশেষ নিয়মে ধ্বনির আগমন, পরিবর্তন ও লােপকে সংক্ষেপে ধ্বনি পরিবর্তন বলা হয়।

এই আর্টিকেলটি পড়লে যা যা জানতে পারবেন

প্রশ্নঃ উচ্চারণের সুবিধার জন্য সংযুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনির মাঝখানে স্বরধ্বনি আসলে তাকে কি বলে ?

উত্তরঃ উচ্চারণের সুবিধার জন্য সংযুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনির মাঝখানে স্বরধ্বনি আসলে তাকে মধ্য স্বরাগম বিপ্রকর্ষ বা স্বরভক্তি বলে।

ধ্বনি পরিবর্তনের নিয়ম

১। আদি স্বরাগম: উচ্চারণের সুবিধার জন্য বা অন্য কোন কারণে শব্দের আদিতে স্বরধ্বনি আসলে তাকে বলে আদি স্বরাগম।
যেমন- স্ত্রী > ইস্ত্রি, স্কুল > ইস্কুল, স্টেশন > ইস্টিশন। এরূপ আস্তাবল, আস্পর্ধা ইত্যাদি।

২। মধ্য স্বরাগম, বিপ্রকর্ষ বা স্বরভক্তি: সময় সময় উচ্চারণের সুবিধার জন্য সংযুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনির মাঝখানে স্বরধ্বনি আসে। এরূপ স্বরকে বলা হয় মধ্য স্বরাগম।
যেমন-
» = রত্ন > রতন, ধর্ম > ধরম, স্বপ্ন > স্বপন, হর্ষ > হরষ ইত্যাদি।
» = মুক্তা > মুকুতা, তুর্ক > তুরুক, ভ্রু > ভুরু।
বেঞ্চ > বেঞ্চি ইত্যাদি।

৩। অন্ত্য স্বরাগম: কোন কোন সময় শব্দের শেষে অতিরিক্ত স্বরধ্বনি আসে। এরূপ স্বরাগমকে বলা হয় অন্ত্য স্বরাগম। যেমনঃ দিশ > দিশা, পােখত > পােক্ত, বেঞ্চ > বেঞ্চি ইত্যাদি।

৪। অপিনিহিতি: পরের ই-কার ও উ-কার আগে উচ্চারিত হলে কিংবা যুক্তব্যঞ্জন ধ্বনির আগে ই-কার বা উ-কার উচ্চারিত হলে তাকে অপিনিহিতি বলে।
যেমন:- আজি > আইজ, সাধু>সাউধ, রাখিয়া > রাইখ্যা, বাক্য > বাইক্য।

৫। অসমীকরণ: একই স্বরের পুনরাবৃত্তি দূর করার জন্যে শব্দের মাঝখানে যখন “আ” স্বরধ্বনি যুক্ত হয় তখন একে বলে অসমীকরণ।
যেমন:- ধপ + ধপ = ধপাধপ, টপ + টপ = টপাটপ ইত্যাদি।

৬। স্বরসঙ্গতি: একটি স্বরধ্বনির প্রভাবে শব্দে অপর স্বরের পরিবর্তন ঘটলে তাকে স্বরসঙ্গতি বলে। যেমন- দেশী > দিশি, বিলাতি > বিলিতি ইত্যাদি ।

ক) প্রগত: আদিস্বর অনুযায়ী অন্ত্যস্বর পরিবর্তন হলে প্রগত স্বরসঙ্গতি হয়। যেমন- মূলা > মূলাে, শিকা > শিকে।
খ) পরাগত: অন্ত্যস্বরের কারণে আদ্যস্বর পরিবর্তিত হলে পরাগত স্বরসঙ্গতি হয় । দেশি > দিশি, নাকি > নিকি। আখাে > আখুয়া > এখাে।
গ) মধ্যগত: আদ্যস্বর ও অন্ত্যস্বর কিংবা আদ্যস্বর অথবা অন্ত্যস্বর অনুযায়ী মধ্যস্বর পরিবর্তিত হলে মধ্যগত স্বরসঙ্গতি হয়। যেমন- বিলাতি > বিলিতি ইত্যাদি।

৭। সম্প্রকর্ষ বা স্বরলােপ: দ্রুত উচ্চারণের জন্য কেবল শব্দের আদি, অন্ত্য বা মধ্যবর্তী কোন স্বরধ্বনি লােপকে বলা হয় স্বরলােপ বা সম্প্রকর্ষ ।
যেমন- বসতি > বস্ তি, জানালা > জান্ লা ইত্যাদি ।

ক) আদি স্বরলােপ: পাদ + উদ্ ক > পা + উদক > পাদক, অলাবু > লাউ, উদ্ধার > উধার > ধার।
খ) মধ্যস্বর লােপ: অগুরু > অগ্রু, সুবর্ণ > স্বর্ণ, > রাধনা > রান্না, গৃহিণী > গিরিণী > গিরণী > গিন্নী।
গ) অন্ত্যস্বর লােপ: আশা > আশ, আজি > আজ।

ধ্বনি পরিবর্তন -এর আরো কিছু নিয়ম

৮। ধ্বনি বিপর্যয়: শব্দের মধ্যে দুটো ব্যঞ্জনের পরস্পর স্থান পরিবর্তন ঘটলে তাকে ধ্বনি বিপর্যয় বলে। যেমন, ইংরেজি বাক্স > বাংলা উচ্চারণ বাস্ ক, জাপানি
রিক্স > বাংলা রিস্ কা ইত্যাদি। অনুরূপভাবে, পিশাচ > পিচাশ, লাফ > ফাল।

৯। সমীভবন: শব্দমধ্যস্থ দুটো ভিন্ন ধ্বনি একে অপরের প্রভাবে অল্প বিস্তার সমতা লাভ করে। এ ব্যাপারকে বলা হয় সমীভবন। যেমন- জন্ম > জম্ম, কাঁদনা >
কান্না ইত্যাদি।

ক) প্রগত সমীভবন: পূর্ব ধ্বনির প্রভাবে পরবর্তী ধ্বনির পরিবর্তন ঘটে। একে বলে প্রগত সমীভবন।
যেমন- চক্র > চক্ ক, পক্ব > পক্ ক, পদ্ম > পদ্দ, লগ্ন > লগ্ গ ইত্যাদি।
খ) পরাগত সমীভবন: পরবর্তী ধ্বনির প্রভাবে পূর্ববর্তী ধ্বনি পরিবর্তিত হয়; একে বলে পরাগত সমীভবন।
যেমন- তৎ + জন্য > তজ্জন্য, তৎ + হিত >তদ্ধিত, উৎ + মুখ > উন্মুখ ইত্যাদি।
গ) অনন্যান্য সমীভবন: যখন পরস্পরের প্রভাবে দুটো ধ্বনিই পরিবর্তিত প্রভাবে দুটো ধ্বনি পরিবর্তিত হয় তখন তাকে বলে অন্যোন্য সমীভবন।
যেমন- সংস্কৃত সত্য > প্রাকৃত সচ্চ, সংস্কৃত বিদ্যা > প্রাকৃত বিজ্জা।

১০। বিষমীভবন: দুটো সমবর্ণের একটির পরিবর্তনকে বিষমীভবন বলে। যেমন- শরীর > শরীল, লাল > নাল, মর্মর > মার্বেল ইত্যাদি।

১১। দ্বিত্ব ব্যঞ্জন: কখনাে কখনাে জোর দেবার জন্য শব্দের অন্তর্গত ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব উচ্চারণ হয়। একে বলে ব্যঞ্জনদ্বিত্ব ।
যেমনঃ পাকা > পাক্কা, সকাল > সক্কাল ইত্যাদি।

১২। ব্যঞ্জন বিকৃতি: শব্দ-মধ্যে কোন কোন সময় কোন ব্যঞ্জন পরিবর্তিত হয়ে নতুন ব্যঞ্জন ধ্বনি ব্যবহৃত হয়। একে বলে ব্যঞ্জন বিকৃতি।
যেমন- কবাট > কপাট, ধােবা > ধােপা, ধাইমা > দাইমা ইত্যাদি।

১৩। ব্যঞ্জনচ্যুতি: পাশাপাশি সম উচ্চারণের দুটো ব্যঞ্জনধ্বনি থাকলে তার এটি লােপ পায়। এরূপ লােপকে বলা হয় ধ্বনিচ্যুতি বা ব্যঞ্জনচ্যুতি ।
যেমন- বউদিদি > বউদি, বড়দাদা> বড়দা > বদ্দা ইত্যাদি।

১৪। অন্তর্হতি: পদের মধ্যে কোন ব্যঞ্জনধ্বনি লােপ হলে তাকে বলে অন্তহতি । যেমন:- ফাল্গন > ফাগুন, ফলাহার > ফলার, ইত্যাদি।

১৫। অভিশ্রুতি: বিপর্যস্ত স্বরধ্বনি পূর্ববর্তী- স্বরধ্বনির সাথে মিলে গেলে এবং তদানুসারে পরবর্তী স্বরধ্বনির পরিবর্তন ঘটলে তাকে বলে অভিশ্রুতি
যেমন- করিয়া> কইরিয়া> কইরা> করে। এরূপ শুনিয়া> শুনে, বলিয়া> বলে।

১৬। র-কার লােপ: তর্ক >তক্ক, করতে>কত্তে, মারল>মাল ইত্যাদি।

১৭। হ-কার লােপ: পুরােহিত > পুরুত, গাহিল > গাইল, চাহে > চায়, সাধু > সাধৃ > সাহু > সাউ ইত্যাদি।

তো এই ছিলো ধ্বনি পরিবর্তন এর নিয়মসমূহ। আশা করি বুঝতে পেরেছেন। প্রয়োজন মনে করলে আপনার বন্ধুদেরও শেয়ার করতে পারেন।

আরো পড়ুনঃ সাধু ও চলিত ভাষার পার্থক্য।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button