পশুপালন সমাজ

পশুপালন সমাজ: মানুষ যখন অরণ্যচারী ছিল তখন পশু আর মানুষের মধ্যে পার্থক্য ছিল সামান্যই। কিন্তু বুদ্ধি, পারস্পরিক সহযোগিতা ও সংঘবদ্ধতার কারণে মানুষ পশুকুলকে বশ মানিয়ে গৃহপালিত করতে সক্ষম হয়। পণ্ডিতদের ধারণা তিন হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিসর, মেসোপটেমিয়া এবং ভারতে বন্য পশুকে গৃহপালিত করা হয়। পশুপালন সমাজ ব্যবস্থা এবং পশুপালন সমাজের বৈশিষ্ট্য নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হল।
পশুপালন সমাজ ব্যবস্থা
খাদ্য উৎপাদন অর্থনীতি প্রাথমিক স্তর হচ্ছে পশুপালন অর্থনীতি। মানুষ তার শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েই পশুর উপর প্রভুত্ব করার ক্ষমতা অর্জন করে। এক্ষেত্রে মানুষ প্রথমে কুকুরকে গৃহপালিত করতে সক্ষম হয় অস্ট্রেলিয়ায় বিশ হাজার বছর পূর্বের মানুষের সাথে কুকুরের দেহাবশেষ পাওয়া গেছে। কুকুর ছাড়াও এ সময় মানুষ তার শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে ঘোড়া, গরু, গাধা, ছাগল, ভেড়া, উট, বিড়াল ইত্যাদি স্তন্যপায়ী প্রাণীকে বশ মানিয়ে গৃহপালিত করে।
গৃহপালিত পশুর সাহায্যে মানুষ বন্য পশু শিকার করত। একসময় তারা বুঝতে পারে, নির্বিচারে পশু শিকার করলে এমন একটা সময় আসবে যখন জঙ্গলে আর পশু অবশিষ্ট থাকবে না। তাছাড়া শিকারের ক্ষেত্রে দারুণ অনিশ্চয়তা ছিল। তাই মানুষ পশুপালনে আগ্রহী হয়ে ওঠে। পশুপালনের মাধ্যমে মানুষের খাদ্যাভাব ও খাদ্যের অনিশ্চয়তা অনেকখানি দূর হয়। মানুষ পশুর মাংস, দুধ খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করত এবং চামড়া দিয়ে পোশাক এবং হাড় দিয়ে অস্ত্র, যন্ত্রপাতি, সূঁচ ইত্যাদি তৈরি করত।
পশুপালন সমাজ সম্পর্কে Haviland তাঁর ‘Anthropology‘ গ্রন্থে বলেছেন, “পরিবেশের সাথে মানুষের অভিযোজনের একটি চমৎকার উদাহরণ হচ্ছে পশুপালনকারী, যিনি বিভিন্ন ধরনের গবাদি পশু-প্রাণিকে গৃহপালিত করার সাথে সম্পৃক্ত। প্রাণির মধ্যে ভেড়া, ঘোড়া এবং উট উল্লেখযোগ্য। সাধারণত পশুপালন হচ্ছে অঢেল তৃণভূমি, পর্বত, মরুভূমি অথবা অন্য কোন অঞ্চল যা উদ্যানকৃষি বা কৃষিকাজের জন্য উপযুক্ত নয়।”
Lowie তাঁর ‘An Introduction to Cultural Anthropology’ গ্রন্থে বলেছেন, কেবল আর্থিক কারণে পশুকে গৃহপালিত করা হয়নি। পশুর প্রতি অনুগ্রহ এবং ধর্মীয় অনুভূতির কারণে ও পশু বলী দেয়ার উদ্দেশ্যে পশুপালন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মানুষের যাতায়াত এবং মালপত্র বহনে ঘোড়া-গাধা ইত্যাদি ব্যবহৃত হত। এ সময় মানুষের মধ্যে যাযাবরী জীবন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল।
তৃণভূমি, পানি, নিরাপদ আশ্রয় ইত্যাদির খোঁজে মানুষকে একস্থান থেকে অন্যস্থানে ঘুরে বেড়াতে হত। এদের স্থায়ী সমাজ, রাষ্ট্র বা অর্থব্যবস্থা ছিল না। পশুপালনকারী শ্রেণি ছিল মূলত যাযাবর, বেদুঈন। তারা দুর্ধর্ষ ও শক্তিশালী ছিল। তাই স্থায়ী ও কৃষিভিত্তিক সমাজ প্রায়ই এদের দ্বারা আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হত। তবে কালক্রমে অনেক যাযাবর সম্প্রদায় পশুপালন ছাড়াও কৃষিকাজে সম্পৃক্ত হয়ে স্থায়ী জীবন ও সমাজব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
বর্বর দশা ও প্রস্তর যুগের মধ্যভাগে পশুপালন সমাজব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে ১৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আমেরিকায় এবং ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভারতের সিন্ধু, খাইবার গিরিপথ প্রভৃতি স্থানে পশুচারণের স্পষ্ট নিদর্শন পাওয়া গেছে। ইরাক, প্যালেস্টাইন, ওয়াজিয়ান নাতুফ, ইরানের জাগ্রোস পাহাড়ের পাদদেশে পশুপালন সমাজব্যবস্থা প্রচলিত ছিল বলে নৃবিজ্ঞানী ও প্রত্নতাত্ত্বিকগণ মনে করেন। বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ; যেমন— ওল্ড টেস্টামেন্ট, কুরআন শরীফ প্রভৃতিতেও পশুপালন অর্থনীতির উল্লেখ রয়েছে।
পশুপালন সমাজব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য

পশুপালন সমাজের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:
১। খাদ্যের নিশ্চয়তা: বর্বর দশার প্রথম স্তরে মাটির পাত্র আবিষ্কৃত হয়। তাই এ সময় মানুষ মাংস, দুধ ইত্যাদি সংরক্ষণ করতে পারত। এছাড়া যে কোন সময় প্রয়োজন হলে গৃহপালিত পশু থেকেও খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে পারত।
২। যাযাবর বৃত্তি: পশুপালনের প্রয়োজনেই মানুষকে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াতে হত। একটি নির্দিষ্ট স্থানের ঘাস, পানি প্রভৃতি ফুরিয়ে গেলে আবার নতুন কোথাও চলে যেতে হত। যেমন মানুষ আ অঞ্চলে কিছুদিন বসবাস করার ফলে সেখানকার ঘাস কমে গেলে B অঞ্চলে স্থানান্তরিত হত। একসময় এখানেও পশুর খাদ্যাভাব দেখা দিত। কখনো কখনো আবহাওয়াও প্রতিকূল মনে হত। মানুষ তখন আবার A অঞ্চলে ফিরে আসত। কেননা ততদিনে এখানে নতুন ঘাস জন্মেছে; পানি, ফলমূল এবং পরিবেশেও বসবাসোপযোগী হয়ে উঠেছে।
৩। জনসংখ্যার স্বল্প ঘনত্ব: পশুচারণ সমাজে ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক কারণে মানুষের প্রজনন ছিল সীমিত। যাযাবরদের যুদ্ধবিগ্রহ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, হিংস্র প্রাণির আক্রমণ ইত্যাদিও মানুষ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তাই এখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব কম ছিল। এগুলো ছাড়াও প্রকৃতির উপর নির্ভরতা, স্বল্পমাত্রার প্রযুক্তি, লিঙ্গভিত্তিক শ্রম বিভাজন, ক্ষুদ্র পরিসরে যূথবদ্ধ সমাজ, ব্যক্তিগত মালিকানা ও সামাজিক স্তরবিন্যাসের অনুপস্থিতি ইত্যাদি পশুপালন আৰ্থ-সামাজিক অবস্থার বৈশিষ্ট্য ছিল বলে মনে করা হয়।